ভূমিকা

বাংলাদেশে দুটো সাধারণ, অথচ অত্যন্ত শক্তিশালী শব্দ, ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘ইসলাম’, প্রায়শই প্রতারকদের দ্বারা ব্যবহৃত হয় মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। কেউ উচ্চশিক্ষিত হোক, সাধারণ শিক্ষিত হোক কিংবা অশিক্ষিত—’বিজ্ঞান’ এবং ‘ইসলাম’ শব্দদ্বয় দ্বারা সহজেই প্রতারণার শিকার হয়। প্রতারকরা এই শব্দগুলো ব্যবহার করে মানুষকে ফাঁদে ফেলার কৌশল রপ্ত করেছে, আর দুঃখের বিষয় হলো, মানুষও এই শব্দগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা বা বিশ্বাসের কারণে প্রতারিত হতে থাকে। এই ব্যাপক প্রতারণা দেশের একটি উদ্বেগজনক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ এমন স্কিমের শিকার হচ্ছে, যেগুলো ‘বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন’ বা ‘ইসলামী বিশুদ্ধতা’র ছদ্মাবরণে চলছে।

যদিও দেশে বিজ্ঞান চর্চা বা উদ্ভাবন তেমন জনপ্রিয় নয় বা প্রতিষ্ঠিত নয়, ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি নিজে বেশ জনপ্রিয় এবং সম্মানিত। মানুষ বিজ্ঞানকে পূর্ণভাবে না বুঝলেও এই শব্দটির প্রতি তাদের আকর্ষণ বিপুল, আর এই আকর্ষণকে ব্যবহার করেই প্রতারকরা তাদের ফাঁদ পাতে। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞাপনগুলোতে দাবি করতে দেখা যায় যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে ত্রিশ দিনে ইংরেজি শেখানো হয়। আবার কেউ ভাগ্য গণনা করে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। এগুলো প্রকৃতপক্ষে কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়াই মানুষকে আকৃষ্ট করে, কারণ ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

মানুষের মধ্যে এমন একটি মানসিকতা রয়েছে যে, কোনকিছুতে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি যুক্ত থাকা মানেই সেটি নির্ভরযোগ্য বা আধুনিক কিছু হবে; অথচ বাস্তবে তা নয়। প্রতারকরা বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে প্রভাবিত করে এবং তাদের প্রকৃত বিজ্ঞানবিরোধী কার্যক্রম গোপন করে। তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং ‘আধুনিক জীবনযাপনের পদ্ধতি’ বা ‘সুখী জীবনের বিজ্ঞান’ এর মতো নাম দিয়ে ধোঁকা দেয়।

বাংলাদেশে ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত। এই বিশ্বাসের সুযোগ নিতেই প্রতারকরা ‘ইসলামী’ বা ‘হালাল’ শব্দগুলো ব্যবহার করে। মানুষ যেকোনও কিছুতে এই শব্দদ্বয় দেখলেই তা বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে। অনেক প্রতারকই তাদের পণ্য বা সেবা ‘ইসলামী’ বা ‘হালাল’ বলে প্রচার করে, যদিও তাদের প্রকৃতপক্ষে ইসলামিক মূল্যবোধের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের কোনও ব্যবসা বা পণ্য যতই ইসলামবিরোধী হোক না কেন, তা ‘হালাল’ বা ‘ইসলামিক’ বলে বাজারজাত করা হয় এবং মানুষ সেটিকে গ্রহণ করে। এই ধর্মীয় বিশ্বাসের ভুল ব্যবহার শুধু অর্থনৈতিক প্রতারণা নয়, বরং ধর্মীয় বিভ্রান্তিরও জন্ম দেয়। মানুষ প্রকৃতপক্ষে কীভাবে তাদের ধর্মকে পালন করবে, তা ভুলভাবে শিখতে শুরু করে।

‘বিজ্ঞান’ এবং ‘ইসলাম’ শব্দ দুটো একত্রে ব্যবহার করা হলে প্রতারণার একটি শক্তিশালী অস্ত্র তৈরি হয়। প্রতারকরা এই দুটি শব্দ একত্রিত করে তাদের প্রতারণাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য ও সম্মানজনক করে তোলে। এভাবেই শহীদ আল বোখারী মহাজাতক তার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডকে সফলভাবে পরিচালনা করেছেন, যেখানে তিনি ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘ইসলাম’ একত্রিত করে প্রতারণার এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছেন।

মহাজাতক তার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে বিজ্ঞান ও ধর্মকে এমনভাবে মিশিয়েছেন, যা মানুষের মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ মহাজাতকের এই বিজ্ঞান ও ধর্মের মিশ্রণকে বিশ্বাস করে তার প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়।

বাংলাদেশের অনেক প্রতারকের মধ্যে শহীদ আল বোখারী মহাজাতক প্রতারণার ক্ষেত্রে একটি অগ্রণী উদাহরণ। বহু বছর ধরে তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়ের অপব্যবহার করে একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তার মিথ্যাচার ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক উভয় ভিত্তির অপব্যবহারের উপর দাঁড়িয়ে আছে এবং এর মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার মানুষের জীবনকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছেন।

মহাজাতক তার ক্যারিয়ার শুরু করেন গণনা বা রাশিফল লেখার মাধ্যমে। কিন্তু তার দৃষ্টি খোলে যখন তিনি ধ্যান বা মেডিটেশনের ধারণা খুঁজে পান। বাংলাদেশে ধ্যান প্রথমবারের মতো পরিচিত হয় মাহী কাজী নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে, যিনি সিলভা মেথড নামক এক ধ্যান পদ্ধতি নিয়ে আসেন, যার প্রবর্তক ছিলেন হোসে সিলভা নামক স্প্যানিশ-মেক্সিকান একজন ব্যক্তি। মহাজাতকসহ বহু তারকা ব্যক্তিত্ব এই সিলভা মেথড শিখেছিলেন।

মহাজাতক তার প্রতারণামূলক কার্যক্রমে এই মেডিটেশন পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং এর সাথে কোরআনের আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা, জাল হাদিস ও জ্যোতিষশাস্ত্রের মিশ্রণ ঘটিয়ে ‘কোয়ান্টাম মেথড’ নামে বাজারজাত করেন। এতে মানসিকভাবে বিপন্ন ও হতাশাগ্রস্ত মানুষদের জন্য একটি কার্যকর প্রতারণার ফাঁদ তৈরি হয়, যা তিনি ‘দ্য সায়েন্স অব লিভিং’ নামে প্রচার করেন।

মেডিটেশনের নামে তিনি হতাশাগ্রস্ত, মানসিক বা শারীরিকভাবে বিপন্ন মানুষদের তার শিকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেন। তিনি নিজেকে একজন ‘গুরুজি’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, যিনি মানসিক শান্তি, সফলতা ও সুখ এনে দিতে পারেন। এতে প্রচুর মানুষ আকৃষ্ট হয় এবং প্রতারণার শিকার হয়।

মহাজাতক এই প্রতারণামূলক কার্যক্রমে বিজ্ঞান ও ধর্মকে এমনভাবে মিশিয়েছেন, যা মানুষকে আরও বেশি বিশ্বাসী করে তুলেছে। তার অনুসারীরা তাকে একজন সত্যিকারের ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক গুরু হিসেবে মেনে নিয়েছে, এবং তারা তার ফাঁদে ধরা পড়ে তাদের অর্থ ও স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে।

মহাজাতকের একটি প্রধান কৌশল হলো দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রচারণায় ব্যবহার করা। এই কৌশলের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন। মহাজাতক বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যেমন রাজনীতিবিদ, তারকা বা ব্যবসায়ীদের সাথে যুক্ত হয়েছেন এবং তাদের সমর্থন লাভ করেছেন। কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি তার প্রতারণামূলক কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন না, ফলে তারা নিজেদের অজান্তেই মহাজাতকের প্রতারণার কার্যক্রমকে বৈধতার মোড়ক দেন।

মহাজাতক শুধুমাত্র মানসিক বা আধ্যাত্মিক প্রতারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তিনি একটি সুসংবদ্ধ ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি ব্যাপক অর্থ সংগ্রহ করেছেন। যাকাত ফান্ড, মসজিদ ফান্ড, ‘হিলিং’ সেবা, এবং সিজনাল দান (যেমন, বন্যা, কোভিড-১৯) এর মতো বিভিন্ন উৎস থেকে তিনি অর্থ সংগ্রহ করেন।

মহাজাতকের প্রধান অর্থ সংগ্রহের উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো দানের মাধ্যমে প্রতারণা। অনুসারীরা মহাজাতকের নির্দেশে দান করে। তারা বিশ্বাস করে যে তারা ধর্মীয় বা মানবিক কাজে অবদান রাখছেন। কিন্তু বাস্তবে এই অর্থের একটি বিশাল অংশ মহাজাতকের নিজস্ব সম্পদে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট মহাজাতকের মতো প্রতারকদের সফলভাবে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। দেশের অনেক মানুষ বিজ্ঞান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি গভীর আবেগ থাকার কারণে প্রতারণার ফাঁদে পড়েন। ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘ইসলাম’ এর সম্মানকে কাজে লাগিয়ে প্রতারকরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে প্রতারণার শিকার বানায়।

মহাজাতকের কর্মকান্ডে শিরক, বিদ’আত, কুফর-এর ছড়াছড়ি রয়েছে। কখনো কেউ মহাজাতকের ভন্ডামি নিয়ে প্রমাণসহ কথা বললে মহাজাতক তাঁর শিষ্যদের নিকট তাকে ‘মুর্খ’ ‘অভিশপ্ত’ ‘কুকুর’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করে এড়িয়ে যান। মহাপ্রতারক মহাজাতকের বহুমূখী প্রতারণামূলক কর্মকান্ডবিষয়ক এই ব্লগসাইট তৈরিতে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের গ্রাজুয়েট ও প্রোমাস্টার সদস্যবৃন্দ, প্রাক্তন কর্মী ও দেশের বিজ্ঞ আলেমদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের উত্তম পুরষ্কার দান করুন।

ওয়েবসাইটের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা

ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সকল তথ্য নেয়া হয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের গ্রাজুয়েট, প্রোমাস্টার, বিভিন্ন স্তরের  প্রাক্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দের নিকট হতে। তাঁরা যা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সেগুলিই বর্ণিত হয়েছে এখানে। এছাড়াও, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট, বই এবং আভ্যন্তরীন বিভিন্ন প্রোগ্রামের আলোচনা থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন এমন কারও মনগড়া মতামত এখানে স্থান পায়নি। অতএব, এই ওয়েবসাইটটি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের আভ্যন্তরীন কর্মকান্ডের একটি নির্ভরযোগ্য প্রামান্য দলিল।

ব্লগ পোস্টসমূহ

অনিয়ম ও অপরাধসমূহ

Face the People (Live) – ফেইস দা পিপল (লাইভ)

শায়খ আহমাদুল্লাহ’র বক্তব্য

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের বক্তব্য

অন্যান্য আলেমগণের বক্তব্য